আপনাদের আন্তরিক অভিন্দন ও শুভেচ্ছা

Sunday, July 1, 2018

আইনের দৃষ্টিতে দেনমোহর কি এবং কেন? সমস্যা, অধিকার, প্রতিকার এবং সকল জিজ্ঞাসা


দেনমোহর কি
দেনমোহর বিবাহিত মুসলিম নারীর একটি বিশেষ অধিকার। এই অধিকার মুসলিম আইনের উৎস পবিত্র কুরআন দ্বারা স্বীকৃত। মুসলিম আইন অনুযায়ী দেনমোহর হলো বিয়ের একটি শর্ত এবং স্ত্রীর একটি আইনগত অধিকার। এই অধিকার বলে স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে কিছু পরিমাণ অর্থ বা সম্পত্তি পাওয়ার অধিকারী হয়৷দেনমোহর স্ত্রীর কাছে স্বামীর ঋণ স্বরূপ এবং অবশ্যই পরিশোধযোগ্য।


দেনমোহর সংক্রান্ত আইন
১। মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ ২। মুসলিম আইন ৩। পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫


আইনগত ব্যাখ্যা: মুসলিম আইন অনুযায়ী
বিয়ের সময় যদি দেনমোহর নির্ধারণ করা না হয় এমনকি স্ত্রী পরবর্তীতে কোন দেনমোহর দাবী করবে না এ শর্তে বিয়ে হয় তাহলেও স্ত্রীকে উপযুক্ত দেনমোহর দিতে হবে৷ দেনমোহর ছাড়া বিয়ে বাতিল হয় না, বৈধই থাকে তবে শর্ত থাকে বিয়ের পর অবশ্যই উপযুক্ত দেনমোহর দিতে হবে। মোহরানা হল মুসলিম বিবাহের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য এবং এটা যদি বিবাহের সময় অনির্ধারিত থাকে, তবে তা অবশ্যই কোন স্পষ্ট নীতিমালা দ্বারা নির্ধারণ করতে হবে।

মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ অনুযায়ী
মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের (১০) ধারায় বলা হয়েছে – মুসলিম বিবাহের ফলস্বরূপ যেই অর্থ বা সম্পত্তি স্বামী তাহার স্ত্রীকে প্রদান করেন বা দিতে স্বীকার করেন,সেই অর্থ বা সম্পত্তিকে দেনমোহর বলা হয়। কোন বিবাহে দেনমোহরের কথা না থাকলেও আইন স্ত্রীকে দেনমোহরের অধিকার দেয়। স্ত্রীর প্রতি মর্যাদার চিহ্নস্বরূপ স্বামী উপর ইসলামী আইন এই দায়িত্ব অর্পন করিয়াছে। ইসলামে বিবাহের মর্যাদার চিহ্নস্বরূপ মোহরানা একটি আবশ্যিক দায়িত্ব। এই দায়িত্ব এতই গুরুত্বপূর্ণ যে,বিবাহের সময় ইহা নির্ধারিত না থাকলেও আইনতঃ পরবর্তী কালে ইহা নির্ধারণের ব্যবস্থা রয়েছে।


দেনমোহরের প্রকারভেদ
দেনমোহরের মূলতঃ দুই প্রকারের, যথা:
(ক) নির্ধারিত দেনমোহর: যেক্ষেত্রে বিবাহের চুক্তিতে বা বিবাহের পূর্বে কিংবা পরে দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারিত হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে উহা নির্ধারিত দেনমোহর। এইরূপ দেনমোহরের জন্য কোন সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থ নির্ধারিত নাই। দেনমোহর হিসাবে যে কোন পরিমাণ অর্থ নির্ধারিত হতে পারে, যদিও তাহা স্বামী কর্তৃক পরিশোধের ক্ষমতার বাহিরে, কিন্তু কোন অবস্থায়ই আইনে নির্ধারিত পরিমাণের কম হইতে পারিবে না।

(খ) উপযুক্ত দেনমোহর: যেক্ষেত্রে বিবাহের চুক্তিতে বা বিবাহের পূর্বে দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারিত হয় না সেইক্ষেত্রে স্ত্রীকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ হিসাবে দেনমোহর পরিশোধ করার জন্য আইন দ্বারা নির্ধারণ করা হয়, তাকে উপযুক্ত দেনমোহর বলে৷যখন এইরূপ কোন প্রকাশ্য শর্তে বিবাহের চুক্তি সম্পাদিত হয় যে, কোন মোহরানা পরিশোধ করা হবে না অথবা যখন কোন মোহরানার পরিমাণ ধার্য করা না হয় তখন সেই বিবাহের ক্ষেত্রে স্ত্রী ন্যায্য বা উপযুক্ত পরিমাণ মোহরানা পাওয়ার অধিকারী হন।


দেনমোহর কেন দেওয়া হয়?
দেনমোহর স্ত্রীর অধিকার সংরক্ষনের জন্য এবং স্ত্রীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য দেয়া হয়। এটি স্বামীর উপর আইন কর্তৃক আরোপিত একটি দায়।


দেনমোহরের পরিমাণ কিভাবে নির্ধারন করা হয়?
দেনমোহরের কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ নাই। যে কোন পরিমাণ অর্থ দেনমোহর হিসাবে নির্ধারিত হতে পারে। দেনমোহর যেহেতু স্ত্রীর আর্থিক নিরাপত্তার জন্য দেওয়া হয় সে কারণে এর পরিমাণ এতটা কম হওয়া উচিত নয় যা স্ত্রীর আর্থিক নিরাপত্তা বিধানে সহায়ক হবে না। সাধারণত দেখা যায় নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রেখে দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়। বিষয়গুলো হলো:
১। স্ত্রীর পারিবারিক অবস্থা
২। বংশ মর্যাদা
৩। আর্থিক অবস্থা
৪। ব্যক্তিগত যোগ্যতা এবং
৫। স্ত্রীর পরিবারের অন্যান্য মহিলাদের (যেমন – ফুফু, বোন) দেনমোহরের পরিমাণ।

এই বিষয়গুলো বিবেচনা করে দেনমোহর ঠিক করা হয়। দেনমোহর একবার নির্ধারণ করার পর এর পরিমাণ কমানো যায় না তবে স্বামী ইচ্ছা করলে তা বাড়াতে পারেন।

উদাহরণ:
কাসেম ও হালিমার বিয়ের সময় দেনমোহর ধার্য করা হয়নি। হালিমার বড় বোন ও ফুফুর দেনমোহরের পরিমাণ ছিলো ত্রিশ হাজার টাকা। সুতরাং ত্রিশ হাজার টাকা বা তার কাছাকাছি পরিমাণ দেনমোহর বিয়েতে নির্ধারণ করতে হবে।


দেনমোহর ছাড়া কোনো বিয়ে হলে সে বিয়ে কি বাতিল বলে গণ্য হবে?
দেনমোহর বিয়ের আগে, বিয়ের সময় বা বিয়ের পরে যে কোনো সময় নির্ধারণ করা যায়। দেনমোহর ছাড়া বিয়ে হলে বিয়েটি বাতিল হবে না। বৈধই থাকে তবে এক্ষেত্রে শর্ত থাকে যে বিয়ের পর উপযুক্ত দেনমোহর অবশ্যই দিতে হবে। যদি বিয়ের সময় দেনমোহর নির্ধারিত না হয়, এমন কি স্ত্রী কোনো দেনমোহর দাবি করবে না, এমন শর্তেও যদি বিয়ে সম্পাদিত হয়, তবুও স্ত্রীকে উপযুক্ত দেনমোহর দিতে হবে৷ অর্থাত্ কোনো শর্তই এক্ষেত্রে আইন গ্রাহ্য হবে না, দেনমোহর দিতেই হবে।

উদাহরণ:
কাসেম ও হালিমার বিয়েতে দেনমোহরের কথা উল্লেখ ছিলো না এবং কাশেম শর্ত দেয় যে হালিমা দেনমোহর দাবি করবে না। বিয়ের সময়ের এই শর্তটিকে সম্পূর্ণ বাতিল গণ্য করা হবে এবং কাশেমকে অবশ্যই হালিমার পারিবারিক অবস্থা, ব্যক্তিগত যোগ্যতা ইত্যাদির ভিত্তিতে উপযুক্ত ও ন্যায্য দেনমোহর দিতে হবে। বিয়ের সময় দেনমোহর ধার্য করা হয়নি, এই অজুহাতে প্রাপ্য দেনমোহর থেকে হালিমাকে বঞ্চিত করা যাবে না।


স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করলে কি হবে?
স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করলে প্রথম স্ত্রীর সম্পূর্ন দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করতে হবে।


স্ত্রী কি তালাক বা স্বামীর মৃত্যুর আগে দেনমোহর দাবি করতে পারে?
তালাক বা স্বামীর মৃত্যুর আগেই স্ত্রী দেনমোহর দাবি করতে পারে এবং স্বামী তখন নির্ধারিত দেনমোহর পরিশোধ করতে বাধ্য। দেনমোহর স্ত্রীর কাছে স্বামীর ঋণ তাই যে কোনো সময স্ত্রী তা দাবি করতে পারে।


দেনমোহর চেয়ে না পেলে সেক্ষেত্রে স্ত্রী কি করতে পারে?
যদি কোনো স্ত্রী স্বামীর কাছে নির্ধারিত দেনমোহর চেয়ে না পায়,তবে সেই স্ত্রী নিম্নলিখিত কাজগুলো করতে পারে। যেমন –
১। স্বামীর সাথে বসবাস করতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে
২। দাম্পত্য মিলনে অনীহা প্রকাশ করতে পারে
৩। এমন কি সে দূরে বসবাস করতে পারে।

এ সময় স্বামী স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে বাধ্য থাকবে৷ এসময় কোন স্বামী যদি দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য মামলা করে, তবে তার মামলা খারিজ হয়ে যাবে, কারণ স্বামী, স্ত্রীর দাবি অনুযায়ী দেনমোহর পরিশোধ করেনি।

উদাহরণ:
হালিমা, কাসেমের স্ত্রী। বিয়ের পাঁচ বছর পর হালিমা তার প্রাপ্য দেনমোহর দাবি করলো। কিন্তু কাসেম তা দিতে অস্বীকার করে। সে ক্ষেত্রে হালিমা কাসেমের কাছ থেকে দূরে অন্যত্র বসবাস করতে পারবে এবং কাশেম তার ভরণপোষণ দিতে বাধ্য।


স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী কি ভাবে দেনমোহর আদায় করবে?
স্বামীর মৃত্যুর পর দেনমোহর স্ত্রীর কাছে স্বামীর ঋণ হিসেবে ধরা হবে। অন্যান্য ঋণের মতোই এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। দাফন-কাফনের খরচ করার পর অবশিষ্ট সম্পত্তি থেকে দেনমোহর ও অন্যান্য ঋণ পরিশোধ করতে হবে, এমন কি এই ঋণ পরিশোধ না করলে স্ত্রী স্বামীর উত্তরাধিকারীদের বিরুদ্ধে দেনমোহরের জন্য মামলাও করতে পারে।


যদি স্বামীর আগে স্ত্রীর মৃত্যু হয় তাহলেও কি দেনমোহর দিতে হবে?
স্বামীর আগে স্ত্রীর মুত্যু হলেও দেনমোহর দিতে হবে। এক্ষেত্রে স্ত্রীর উত্তরাধিকারীরা এই দেনমোহর পাবার অধিকারী। তারা দেনমোহর পাবার জন্য মামলাও করতে পারে।


স্বামী স্ত্রীকে কোনো উপহার দিলে তা দেনমোহর বলে বিবেচিত হবে না৷
স্বামী স্ত্রীকে কোন কিছু উপহার হিসেবে দিলে তা অবশ্যই দেনমোহর নয়। বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীকে অনেক কিছুই দিতে পারে৷ স্বামী যদি দেনমোহর হিসেবে স্ত্রীকে কিছু দেয়, তবেই তা দেনমোহর বলে বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রে “দেনমোহর বাবদ” কথাটি লেখা থাকতে হবে।

যেমন: জমি হস্তান্তর দলিলে “দেনমোহর বাবদ” কথাটি লেখা না থাকলে এরূপ জমি-দেনমোহর হিসেবে ধরা হবে না।

উদাহরণ:
কাসেম বিয়ের পর হালিমাকে এক বিঘা জমির মালিকানা হস্তান্তর করে এবং এটি উপহার হিসেবে হালিমাকে প্রদান করে। তাদের মধ্যে তালাক হয়ে যাবার পর হালিমার প্রাপ্য দেনমোহর দিতে কাসেম অস্বীকার করে এবং বলে যে ঐ জমিটি সে হালিমাকে দেনমোহর হিসেবে দিয়েছে। জমির দাম দেনমোহরের পরিমাণের চেয়ে বেশি হলেও এটি দেনমোহর হিসেবে ধরা হবে না। কারণ কাসেম হালিমাকে জমি উপহার হিসেবে দিয়েছিল। হালিমা পুরো দেনমোহর পাবার অধিকারী হবে। যদি সে সময়েই কাশেম উল্লেখ করে দিত যে,জমিটি দেনমোহর হিসেবে দেয়া হচ্ছে, তবেই হালিমা পরবর্তীতে আলাদাভাবে দেনমোহর চাইতে পারতো না। বিয়ের সময়ে দেয়া শাড়ী, গয়না ইত্যাদি কখনো দেনমোহরের অংশ হিসাবে বিবেচিত হবেনা৷

অনেক ক্ষেত্রে বিয়ের সময় গয়না,শাড়ি ইত্যাদির মূল্য দেনমোহরের একটি অংশ ধরে উসুল লিখে নেয়া হয়। আসলে বিয়েতে দেয়া উপহার বা উপঢৌকন দেনমোহর নয়। এগুলোকে দেনমোহরের অংশ বলে ধরা যাবে না এবং উসুল বলা যাবে না।


ভরণপোষণ দেনমোহর বলে বিবেচিত হবে না
দেনমোহরের সাথে ভরণপোষণের কোন সম্পর্ক নেই। বিবাহিত অবস্থায় স্ত্রীকে ভরনপোষনের জন্য স্বামীর যে খরচ তা কোনভাবেই দেনমোহরের অংশ বলে বিবেচিত হবে না। আবার বিয়ে-বিচ্ছেদের ফলে স্বামী, স্ত্রীকে যে ভরণপোষণ দেয় তাও দেনমোহরের অংশ নয়৷দেনমোহর এবং ভরণপোষণ দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। একটি পরিশোধ করলে অপরটি মাফ হয়ে যায় না।


দেনমোহর কি কখনো মাফ হয়?
স্ত্রী দেনমোহর মাফ করতে পারে। যদিও স্বামী চাইল আর স্ত্রী সাথে সাথে তা মাফ করে দিলো, বিষয়টা এত সহজ নয়। সহজে দেনমোহর মাফ হয় না। দেনমোহর মাফ করার সময় স্ত্রীর পূর্ণ সম্মতি থাকতে হবে। একই সাথে তাকে স্বেচ্ছায়, কোন রকম প্ররোচণা ছাড়া মুক্তমনে দেনমোহর মাফ করতে হবে।


তথ্যসূত্র
১. পারিবারিক আইনে বাংলাদেশের নারী – আইন ও সালিশ কেন্দ্র, প্রথম প্রকাশ : জুন – ১৯৯৭
২. মুসলিম ও পারিবারিক আইন পরিচিতি – মোহাম্মদ মজিবর রহমান
৩. বাংলাদেশে পারিবারিক আইন ও তার প্রয়োগ -শাহীন আখতার ও ফাওজিয়া করিম, বাংলাদেশ জাতীয় আইনজীবী সমিতি, ১৯৮৭
৪. আইনের কথা – আইন ও সালিশ কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত বিশেষ বুলেটিন, চতুর্থ সংস্করন, মে ২০০৩
৫. অনলাইন


সংগ্রহ: ইন্টারনেট।


No comments:

Post a Comment